Ticker

6/recent/ticker-posts

পৃথিবীর সবচেয়ে নীরব ঘর: অরফিল্ড ল্যাবরেটরির অ্যানেকোয়িক চেম্বার

 পৃথিবীর সবচেয়ে নীরব ঘর: অরফিল্ড ল্যাবরেটরির অ্যানেকোয়িক চেম্বার


পৃথিবী কতটা নীরব হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাইলে যেতে হবে আমেরিকার মিনেসোটার অরফিল্ড ল্যাবরেটরি (Orfield Laboratories)-তে। এখানে রয়েছে এমন একটি ঘর, যা গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে স্থান পেয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে নীরব স্থান হিসেবে। এই ঘরটির নাম অ্যানেকোয়িক চেম্বার (Anechoic Chamber)।

অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন, একটা ঘর কতটা নীরবই বা হতে পারে? বাস্তবে এই ঘরটি এতটাই নিস্তব্ধ যে, সেখানে বসে থাকলে আপনি নিজের হৃদস্পন্দন, ফুসফুসের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ, এমনকি রক্ত চলাচলের ক্ষীণ শব্দও শুনতে পারবেন।

চলুন, এই রহস্যময় ঘরটির নির্মাণ কৌশল, বৈশিষ্ট্য এবং এর আশ্চর্য প্রভাব সম্পর্কে জানি বিস্তারিত।

কী এই অ্যানেকোয়িক চেম্বার?

অ্যানেকোয়িক শব্দের অর্থ হলো ‘ধ্বনি-প্রতিধ্বনির অনুপস্থিতি’। অর্থাৎ এই ঘরে ঢুকলে কোনো শব্দের প্রতিধ্বনি হয় না। এটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে ভেতরের সব শব্দ শোষিত হয়ে যায় এবং বাইরের কোনো শব্দ ভেতরে ঢুকতে না পারে। ফলে এই ঘরে থাকাকালীন আপনি এমন নিস্তব্ধতা অনুভব করবেন, যা বাইরে কোথাও সম্ভব নয়।

এই ঘরের ভেতরে বিশেষ ধরনের ফাইবারগ্লাস ওয়েজ, ডাবল স্টিল এবং কংক্রিটের দেয়াল ব্যবহার করা হয়েছে, যার ফলে শব্দ ঢোকে না এবং প্রতিধ্বনি তৈরি হয় না।

রেকর্ড করা নিস্তব্ধতা

গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুযায়ী, অরফিল্ড ল্যাবরেটরির এই চেম্বারে শব্দের মাত্রা নেমে আসে -৯.৪ ডেসিবেল-এ। সাধারণত মানুষের কান ০ ডেসিবেল পর্যন্ত নিস্তব্ধতা অনুভব করতে পারে। তার নিচের শব্দমাত্রা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সম্ভব নয়। কিন্তু এই ঘরে সেই মাত্রাও পার হয়ে যায়।

গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর সবচেয়ে শান্ত প্রাকৃতিক স্থানেও শব্দের মাত্রা হয় প্রায় ২০ ডেসিবেল। সেখানে এই ঘরে তা প্রায় ৩০ ডেসিবেল কম। ফলে এই ঘরটি মানব সভ্যতার তৈরি এক বিস্ময়।

ঘরে থাকা কতটা কঠিন?

যদিও শুনতে শান্তিপূর্ণ মনে হয়, তবে এই ঘরে বেশিক্ষণ থাকা সহজ নয়। নিস্তব্ধতা মানুষের স্নায়ুর ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করে। যারা এই ঘরে প্রবেশ করেন, তারা বলেন, কিছুক্ষণ পর মনে হয় চারপাশের কিছু নেই। সময়ের বোধ হারিয়ে যায়।

অনেকের মতে, একসময় নিজের হৃদস্পন্দনের শব্দ, পেটের শব্দ, এমনকি রক্ত সঞ্চালনের শব্দ পর্যন্ত শুনতে পাওয়া যায়। এতে শারীরিক ও মানসিক অস্বস্তি তৈরি হয়।

এমনকি বিশ্বের অনেক সাহসী মানুষও এই ঘরে ৪৫ মিনিটের বেশি থাকতে পারেননি। অরফিল্ড ল্যাবরেটরি জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি এই ঘরে একঘণ্টার বেশি সময় কাটানোর সাহস দেখাননি।

এই ঘরের ব্যবহার

শুধু গবেষণার জন্য নয়, এই ঘরটি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজেও ব্যবহৃত হয়। যেমন —

ইলেকট্রনিক ডিভাইস টেস্টিং: বিভিন্ন কোম্পানি নতুন মডেলের মাইক্রোফোন, হেডফোন, স্পিকার কিংবা কম্পিউটার হার্ডওয়্যার এখানে পরীক্ষা করে। এতে বোঝা যায়, ডিভাইসটির শব্দ কতটা পরিষ্কার এবং বিকৃতি-মুক্ত।

মানব শরীরের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ: এই ঘরে মানুষের মানসিক এবং শারীরিক প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করা হয়। ধরা হয়, নিস্তব্ধতায় মানুষের স্নায়ু কিভাবে কাজ করে।

নাসার মহাকাশচারী প্রস্তুতি: মহাকাশচারীরা যখন মহাশূন্যের নিস্তব্ধতায় যান, তখন তাদের কেমন লাগবে, সেই অনুভূতি পাওয়ার জন্য এই ঘরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

নির্মাণের গঠন

এই অ্যানেকোয়িক চেম্বার নির্মাণে রয়েছে অভিনব প্রযুক্তি। ঘরের দেয়াল, মেঝে এবং ছাদে বিশেষ ত্রিভুজ আকৃতির ফাইবারগ্লাস ব্লক বসানো হয়েছে, যা শব্দ শোষণ করে নেয়।

বাইরের শব্দ যাতে একদম ঢুকতে না পারে, সেজন্য দেয়ালের পুরুত্ব করা হয়েছে প্রায় ১ মিটার। দেয়ালের বাইরে রয়েছে ডাবল স্টিল এবং কংক্রিটের স্তর

মেঝের নিচে জালের মতো কাঠামো তৈরি করা, যার ওপর মানুষ দাঁড়াতে বা বসতে পারে। এই জালও শব্দ প্রতিফলন আটকায়। ফলে ঘরের ভেতরে শব্দের কোনো প্রতিধ্বনি হতে পারে না।

তথ্যচিত্র: পৃথিবীর সবচেয়ে নীরব ঘর — অরফিল্ড ল্যাবরেটরির অ্যানেকোয়িক চেম্বার

ঘরের নাম

অ্যানেকোয়িক চেম্বার (Anechoic Chamber)

অবস্থান

অরফিল্ড ল্যাবরেটরি, মিনেসোটা, যুক্তরাষ্ট্র

গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড

বিশ্বের সবচেয়ে নীরব ঘর
শব্দমাত্রা: -৯.৪ ডেসিবেল

অ্যানেকোয়িক শব্দের অর্থ

‘ধ্বনি-প্রতিধ্বনিহীন ঘর’

নির্মাণ বৈশিষ্ট্য

  • বিশেষ ত্রিভুজাকার ফাইবারগ্লাস ওয়েজ

  • ডাবল স্টিল ও কংক্রিট দেয়াল

  • শব্দ প্রতিফলন ঠেকানোর জন্য ঝুলন্ত জাল মেঝে

  • দেয়ালের পুরুত্ব: প্রায় ১ মিটার

  • ঘরে থাকা অভিজ্ঞতা

  • হৃদস্পন্দন, শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়

  • ৪৫ মিনিটের বেশি কেউ থাকতে পারেনি

  • সময়-অনুভূতি হারিয়ে যায়

এই ঘরের ব্যবহার

✅ ইলেকট্রনিক ডিভাইস টেস্ট
✅ নাসার মহাকাশচারী প্রশিক্ষণ
✅ মানব স্নায়ু গবেষণা
✅ শব্দপ্রতিরোধী প্রযুক্তি পরীক্ষা

তুলনামূলক শব্দমাত্রা

স্থানশব্দমাত্রা (ডেসিবেল)
সাধারণ ঘর৪০-৫০
নিঃশব্দ লাইব্রেরি৩০-৩৫
প্রাকৃতিক শান্ত স্থান২০
অ্যানেকোয়িক চেম্বার-৯.৪
জানতেন কি?

এই ঘরে অনেকেই প্রবেশের কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথা ঘোরা, অস্বস্তি এবং বিভ্রমে ভুগতে শুরু করেন। এটি মানুষের স্নায়ুতে সরাসরি প্রভাব ফেলে।

উপসংহার

পৃথিবীর সবচেয়ে নিস্তব্ধ ঘর — অরফিল্ড ল্যাবরেটরির অ্যানেকোয়িক চেম্বার শুধু একটি ঘর নয়, বরং মানুষের শ্রবণশক্তি, স্নায়ুবিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির এক অপূর্ব নিদর্শন। এখানে সময় কাটানো যেমন কষ্টকর, তেমনই রোমাঞ্চকর।

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং মহাকাশ গবেষণায় এই ঘরের গুরুত্ব অপরিসীম। নিস্তব্ধতার এই রহস্যময় জগতে প্রবেশ করা এক অনন্য অভিজ্ঞতা, যা একবার হলেও সবার জানা উচিত।


Post a Comment

0 Comments