Ticker

Ad Code

Responsive Advertisement

ভ্যাটের বাইরে ৯৫% প্রতিষ্ঠান

 

ভ্যাটের বাইরে ৯৫% প্রতিষ্ঠান


সরকার রাজস্বের জন্য হাহাকার করছে। যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়, সেটিও আদায় হয় না। ফলে বড় অঙ্কের রাজস্ব ঘাটতির মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অথচ চোখের সামনেই লাখ লাখ ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে, ভোক্তার কাছ থেকে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট হিসেবে কেটেও রাখছে; কিন্তু সরকারের খাতায় জমা দিচ্ছে না।
বলা যায়, দেশের বেশির ভাগ ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানই ভ্যাট দেয় না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবেই সারা দেশে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা ইউনিটের পরিমাণ এক কোটি ১৮ লাখেরও বেশি। এর মধ্যে স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক ইউনিটের সংখ্যা প্রায় ৬৩ লাখ। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে নিবন্ধিত ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র পাঁচ লাখ ৭০ হাজার।
দেশের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যার বিপরীতে নিবন্ধিত ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫ শতাংশেরও নিচে। এর মধ্যে রিটার্ন দেওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা চার লাখ ৮০ হাজার।

ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম হওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা এনবিআরের কাঠামোগত দুর্বলতা হিসেবেই মনে করছেন। অন্যদিকে এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা বিভিন্নভাবে অসহযোগিতা করছেন।

তবে নিবন্ধন বাড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানান তাঁরা। এর আগে ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছিলেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান।

ব্যক্তি পর্যায়ে আয়কর ছাড়াও সেলফোনে কথা বলা থেকে শুরু করে কেনাকাটা, হোটেলে খাওয়া, সিনেমা দেখাসহ দৈনন্দিন লেনদেনে ভোক্তারা ভ্যাট দিচ্ছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে দেশের অর্থনৈতিক ইউনিটগুলোর ৯৫ শতাংশেরও বেশি এখনো ভ্যাটজালের বাইরে। কর-জিডিপি অনুপাতে গোটা বিশ্বেই সবার পেছনে বাংলাদেশ।

এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল ও পাকিস্তানও থেকেও পিছিয়ে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারির তথ্য বলছে, সারা দেশে স্থায়ী অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা ৬২ লাখ ৪৪ হাজার ২১৪। এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে ৩৯ লাখ, শহরে ২৩ লাখ। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (বিআইএন) বা ভ্যাট (মূসক) নিবন্ধনধারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র পাঁচ লাখ ৭০ হাজার। সে অনুযায়ী, স্থায়ী অর্থনৈতিক ইউনিটগুলোর মধ্যে ভ্যাট পরিশোধকারী হিসেবে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান আছে স্থায়ী অর্থনৈতিক ইউনিটের ৯ শতাংশের কিছু বেশি। স্থায়ী অর্থনৈতিক ইউনিট বলতে প্রধানত একটি স্থায়ী জমিতে স্থায়ী কাঠামোর ওপর গঠন করা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে বোঝানো হয়েছে।

প্রাতিষ্ঠানিক ইউনিটগুলোর বেশির ভাগ করজালের বাইরে থাকার পেছনে এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। এ জন্য অটোমেশনের মাধ্যমে সংস্থাটির দক্ষতা বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছেন তাঁরা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও বিআইএন নম্বর একসঙ্গে থাকলে সেখানে রিটার্ন দেখা যাবে। অটোমেশনের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কর আহরণ করা যাবে। এ জন্য জনশক্তি না বাড়িয়ে দক্ষতা বাড়াতে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। এমনিতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে করজালের বাইরে থাকার একটা প্রবণতা রয়েছে।

ভ্যাট আইন অনুযায়ী, দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নিয়োজিত প্রতিটি ইউনিটেরই ভ্যাট নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। এসব প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট পরিশোধের হার নির্ধারণ করে বার্ষিক টার্নওভারের ওপর। যদি কোনো ব্যবসার বার্ষিক টার্নওভার ৩০ লাখ টাকার নিচে হয়, তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট দিতে হবে না। ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকার মধ্যে হলে ৩ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। ৫০ লাখ টাকার বেশি হলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে।

শুধু জুয়েলারি খাতে ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের বাইরে। তাদের নিবন্ধনের আওতায় আনতে এনবিআরকে চিঠিও দিয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)। এনবিআরের জারি করা সম্প্রতি এক চিঠিতে বলা হয়েছে, ভ্যাট আইনে ভ্যাট নিবন্ধনযোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন ও তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিছু পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে বার্ষিক টার্নওভার নির্বিশেষে এবং দেশের সব সুপারশপ, শপিং মলসহ সিটি করপোরেশন ও জেলা শহরের সব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন নেওয়া বাধ্যতামূলক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, নিবন্ধনের বাইরে থাকা সারা দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে ফেব্রুয়ারি ও মার্চের মধ্যে ভ্যাট নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসবে এনবিআর। সে জন্য ফেব্রুয়ারিকে ভ্যাট কমিশনারদের জন্য নিবন্ধনের মাস এবং মার্চকে এনবিআরের জন্য নিবন্ধনের মাস ঘোষণা করা হয়েছে।

এ ছাড়া দেশের বেশির ভাগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন না থাকার কারণে এনবিআরের ভ্যাট বিভাগ কিছু সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিআইএন বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নিচ্ছে। ফলে ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো এসব সেবা নিতে গেলে নিবন্ধন গ্রহণ ও ভ্যাট পরিশোধ করতে বাধ্য হবে।

ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ভ্যাট নিবন্ধনের আওতায় আনতে না পারাকে এনবিআরের সক্ষমতার অভাব বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এনবিআরের ভ্যাট রাজস্ব আহরণ কম হওয়ার পেছনে সংস্থাটির নীতিগত ও কাঠামোগত দুর্বলতাকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ী নেতারাও।

বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অনেক হলেও ভ্যাট নিবন্ধনকারীর সংখ্যা কম। এটি বাড়াতে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোরও সহায়তা দরকার। তবে এখানে করপোরেট কর ১২ শতাংশ বলা হলেও আসলে তা আরো অনেক বেশি। এখানে শুভংকরের ফাঁকি আছে।

আবার দেশের জিডিপির অতিরঞ্জিত হিসাবকেও কর-জিডিপি অনুপাত কম হওয়ার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে দেখছেন অনেকে। বিবিএসের সাময়িক হিসাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের জিডিপির আকার ছিল ৪৫৯ বিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ সংস্থাটির চূড়ান্ত হিসাবে তা ৪৫০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। যদিও অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য মতে, বিবিএসের হিসাবে জিডিপির আকার অন্তত ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিরঞ্জন করে দেখানো হয়েছে।

অর্থনৈতিক ইউনিটগুলোর ৯০ শতাংশেরও বেশি ভ্যাটজালের আওতার বাইরে থাকা প্রসঙ্গে এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, বিবিএসের পরিসংখ্যানে যে স্থায়ী অর্থনৈতিক ইউনিটের তথ্য উঠে এসেছে, তাদের সবাই ভ্যাটযোগ্য নয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থাটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ট্রেডার ও সেবা প্রদানকারীদের একটা বড় অংশ অনিবন্ধিত। তাদের মার্কেট এবং এলাকাভিত্তিক সমিতি ও অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। তারা নানা ধরনের কৌশলে নিবন্ধন নেয় না। নিবন্ধন বাড়াতে ভ্যাট বাস্তবায়ন অনুবিভাগ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর সুফল পাওয়া যাবে।

এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, বিবিএস অস্থায়ী-স্থায়ী যেকোনো দোকানকেই এ হিসাবের মধ্যে নিয়ে এসেছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী সেসব দোকান ভ্যাটযোগ্য কি না সেটি আগে আলাদা করতে হবে। এত দিন ৫০ লাখ থেকে তিন কোটি টাকার ওপরে টার্নওভার হলে ভ্যাট নিবন্ধন নিতে হতো। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ৬২ লাখ স্থায়ী ব্যাবসায়িক ইউনিটের মধ্যে কত লাখের তিন কোটি টাকা পর্যন্ত বার্ষিক টার্নওভার হয়, সেটাও বের করা দরকার।


Post a Comment

0 Comments